জামালপুরের বকশিগঞ্জে পাঁচ সন্তানের জননী মোছা: নাছিমা বেগম। স্বামী, চার ছেলে ও এক কন্যা সন্তান নিয়ে বসবাস করেন জেলার বকশিগঞ্জ উপজেলার নিলক্ষিয়া ইউনিয়নের জানকিপুর দাড়িপুড়া গ্রামে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে পাঁচ সন্তানের মধ্যে তার চারটি ছেলেই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। শুধু স্বাভাবিক রয়েছে মেয়েটি। জন্মের কয়েক মাসের মধ্যে অন্ধত্ত্ব বরন করা ৪টি ছেলে নিয়ে বিপাকে রয়েছে পরিবারটি। অভাবে তাড়নায় অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটছে তাদের। শত অভাবের পরও উচ্চ মাধ্যমিকে লেখাপড়া করছেন নয়ন ও মোফাজ্জল। প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ছেন আজিম উদ্দিন। বিয়ে দিয়েছেন বড় ছেলে নাজমুলকে। সেই ঘরেও রয়েছে দুইটি সন্তান।
অর্থের অভাবে সুচিকিৎসার সুযোগ হয়নিই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী চার ভাই এর। এছাড়া চার ভাই এর ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিতা রয়েছে তাদের পিতা মাতা। তাই সরকারের কাছে আর্থিক ও চিকিৎসা সহায়তার দাবি জানান তারা।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সন্তানের বাবা ফুল মামুদ বলেন – আমার কিছু জমি আছে। ওইডে আবাদ করি আর অটো চালায়ে ১০ জনের সংসারের খাওন চালাইতাছি। লকডাউনে অটো চালানি বন্ধ। এহন কোনো বেলা খায়ে থাহি, কোনো বেলা না খায়ে থাহি। হাজার কষ্টের মধ্যেও তিনডে পুলারে পরাইতাছি। কিন্তু আমি মইরে গেলেগা এই পুলাডিরে দেহার আর কেউ নাই। ওরা অথই সাগরের মধ্যে পইরে যাবো গা। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ আমার পুলাডিরে যদি কিছু এডা ব্যবস্থা কইরে দে তাইলে আমি মইরেও শান্তি পামু।

মা নাছিমা বেগম দেশ বলেন- আমার চারটে পুলাই জন্মের ৫-৭ মাসের মধ্যেই অন্ধ হয়ে যায়। আমার তো অতো টেকা নাই। তাউ আমি কিছু কবিরাজ, ডাক্তার দেখাইছি। আমি চিকিৎসা করাবার পাই নাই টাকার অভাবে। সরকারতো কতো টেহাই খরচ করে। যদি আমার চারটে পুলারে একটু চিকিৎসা করতো। এর মধ্যে দুইডে পুলাউ চোখে দেখবের পাইতো। আমার কইলজে ডা ঠান্ডা হইতো।বড় ছেলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নাজমুল হক (২২) বলেন- চার ভাই এর মধ্যে আমিই একমাত্র বিবাহিত। আমি আমার ছেলে মেয়ের মুখটাউ দেখতে পারতাছি না। আমরা ৪ ভাই এর মধ্যে যদি একটা ভাই দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাইতাম। তাহলে আর ৩টা ভাই চলতে পারতাম। চোখের দৃষ্টি শক্তিটা ফিরে পেলে ছেলে মেয়ের মুখটাতো একটু দেখতে পারতাম। অনেকেই ঘৃনা করে আমাদেরকে। আমরা সমাজে অবহেলিত। আমি চায় না আল্লাহ আর কাউকে অন্ধ বানাক।
দ্বিতীয় ছেলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নয়ন (২০) বলেন, আমি বকশিগঞ্জের গাজী আমানুজ্জামান মডার্ন কলেজে মানবিক বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক ২য় বর্ষে অধ্যায়ন করি। এসএসসিতে আমি জিপিএ ৩.৯৪ পেয়েছি। আমি আর মোফাজ্জ্বল যখন এসএসসি পরীক্ষা দেয় তখন আমাদের শ্রæতি লেখক ভাড়া করতে মোট ২৯ হাজার টাকা খরচ হয়। আমরা সাহায্যের জন্যে অনেক জায়গায় গিয়েছি। অনেকেই প্রতিশ্রæতি দিয়েছে। উনারা কেউ কোনো সাহায্য করেনি। পরে আমার বাবা মা গরু বিক্রি করে আমাদের টাকা দিয়েছে। এখন এইচএসসি পরীক্ষার জন্যও শ্রæতি লেখক প্রয়োজন। কিন্তু‘ আমাদের পক্ষে এখন টাকা জোগাড় করা সম্ভব না। হয়তো অর্থের অভাবে আমরা এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারবো না। সরকার যদি একটু সহায়তা করতো তাহলে আমরা পরীক্ষা দিতে পারবো।
তৃতীয় ছেলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মো: মোফাজ্জ্বল হক (১৭) বলেন- আমি বকশিগঞ্জের গাজী আমানুজ্জামান মডার্ন কলেজে মানবিক বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক ২য় বর্ষে অধ্যায়ন করি। এসএসসিতে আমি জিপিএ ৪.৩৯ পেয়েছি। আসলে সবার মুখেই শুনি এই পৃথিবীটা নাকি অনেক সুন্দর। আমার এই জীবনে কখনো দেখার সুযোগ হয়নি। কখনো জোসনার আলো বা সূর্যের আলো আর পৃথিবীর নানারকম সৌন্দর্য জীবনে দেখার সুযোগ হয়নিই। যদি আমার চোখটা যদি ফিরে পেতাম। তাহলে আমার বাবা মায়ের মুখসহ পৃথিবীর যে এতো সুন্দর্য সেটা যদি উপভোগ করতে পারতাম। তবেই আমার জীবনটা স্বার্থক হতো।
চতুর্থ ছেলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী আজিম উদ্দিন (১২) বলেন- আমি সবে মাত্র ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ি। আমার ইচ্ছা আছে আমি শিক্ষক হবো। আসলে শিক্ষকতা ছাড়া আমাদের আর কোনো চাকরি নেই। তাই আমি বড় হয়ে শিক্ষক হয়ে আমার বাবা মাকে আর কোনো কষ্ট করতে দিবো না।বকশিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: প্রতাপ কুমার নন্দী বলেন- কিছু প্রয়োজনীয় খাবার আছে, যেগুলো না খেলে পুষ্টির অভাবে দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে যায়। এছাড়া কিছু জন্মগত রোগ আছে, সেগুলোর কারনেও মানুষ অন্ধত্ব বরন করে থাকে। এসব নিয়ে অনেক প্রচারনা দরকার। আমরা এই চার ভাইকে একজন আই স্পেশালিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবো। জানার চেষ্টা করবো যে- কি কারনে তারা অন্ধত্ত¡ বরন করেছে। সেটা পরবর্তী চিকিৎসার মাধ্যমে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায় কিনা। এই বিষয়গুলো খুব দ্রæত দেখবো।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর পরিবারটির পাশে দাড়িয়ে সরকারী সহায়তা প্রদানের কথা জানিয়ে বকশীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুন মুন জাহান লিজা বলেন- একই পরিবারের ৪জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর মধ্যে নাজমুল ও মোফাজ্জ¦ল প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন এবং নয়ন ও আজিম উদ্দিন শিক্ষা উপবৃত্তি পাচ্ছেন। তবুও নয়ন ও আজিম উদ্দিনের প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য কার্ড প্রদান করা হবে। এছাড়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা সবসময় তাদের পাশে আছি। সরকারের সুযোগ সুবিধা যেনো তারা পায় এবং সমাজে যেনো তারা পিছিয়ে না থাকে। সে জন্য উপজেলা প্রশাসন সদা তৎপর আছে।